২০২৫ সালে সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ডে নতুন রেকর্ড: ৩৪০ জনের ফাঁসি, বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ
এক বছরে ইতিহাসের সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড
২০২৫ সালে সৌদি আরব মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে নতুন ও উদ্বেগজনক রেকর্ড গড়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি (AFP)–র হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৩৪০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা দেশটির ইতিহাসে এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগের রেকর্ড ছিল ২০২৪ সালে, যখন ৩৩৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই রেকর্ডও ভেঙে গেল।
এই পরিসংখ্যান প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠন, আন্তর্জাতিক মহল এবং কূটনৈতিক মহলে নতুন করে বিতর্ক ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
পরিসংখ্যান: কেন এই সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ
সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের শীর্ষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী দেশগুলোর একটি। সাধারণত মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যার দিক থেকে দেশটি চীন ও ইরানের পরেই অবস্থান করে।
-
২০২৩ সাল: প্রায় ১৭০ জন
-
২০২৪ সাল: ৩৩৮ জন (তৎকালীন রেকর্ড)
-
২০২৫ সাল: ৩৪০ জন (নতুন সর্বোচ্চ রেকর্ড)
বিশেষজ্ঞদের মতে, সংখ্যার এই দ্রুত বৃদ্ধি শুধু অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগের বিষয় নয়, বরং এটি সৌদি সরকারের সাম্প্রতিক নীতি ও কঠোর দমনমূলক কৌশলের প্রতিফলন।
কোন অপরাধে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড?
এএফপি এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০২৫ সালে কার্যকর হওয়া মৃত্যুদণ্ডের একটি বড় অংশ মাদক-সংক্রান্ত অপরাধে।
বিশেষ করে—
-
মাদক পাচার
-
মাদক সংরক্ষণ
-
মাদক চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগ
এই অপরাধগুলোতেই অধিকাংশ ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক আইনে মাদক অপরাধকে সাধারণত “সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ” হিসেবে গণ্য করা হয় না, তবুও সৌদি আরবে এসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে।
এছাড়া আরও যেসব অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে—
-
সন্ত্রাসবাদ ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ
-
হত্যা
-
সশস্ত্র ডাকাতি
-
ধর্ম অবমাননা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র (কিছু ক্ষেত্রে)
ড্রাগ যুদ্ধ’ ও সরকারের কঠোর অবস্থান
২০২৩ সাল থেকে সৌদি আরব সরকার তথাকথিত “War on Drugs” বা মাদকবিরোধী যুদ্ধ আরও জোরদার করে। সরকারের দাবি, যুব সমাজকে রক্ষা করা ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই কঠোর পদক্ষেপ।
কিন্তু সমালোচকদের মতে—
-
এই নীতির ফলে বিচারিক স্বচ্ছতা কমেছে
-
অনেক ক্ষেত্রেই দ্রুত বিচার ও গোপন ট্রায়াল হয়েছে
-
অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ সীমিত ছিল
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মৃত্যুদণ্ডের ভয় ব্যবহার করে অপরাধ দমন একটি স্বল্পমেয়াদি কৌশল, যা দীর্ঘমেয়াদে মানবাধিকার সংকট বাড়ায়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার উদ্বেগ
এই রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যুদণ্ডের খবরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
🔹 অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
সংস্থাটি জানিয়েছে,
“সৌদি আরব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড লঙ্ঘন করছে। বিশেষ করে মাদক অপরাধে মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণ অমানবিক।”
🔹 ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ
ইইউ এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর সৌদি আরবকে বারবার আহ্বান জানিয়েছে—
-
মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করার
-
বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার
-
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির সঙ্গে আইন সামঞ্জস্য করার
তবে সৌদি সরকার এসব সমালোচনাকে “অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সৌদি সরকারের অবস্থান
সৌদি কর্তৃপক্ষের দাবি—
-
দেশের আইন শরিয়াভিত্তিক
-
মৃত্যুদণ্ড কঠোর অপরাধ দমনে কার্যকর
-
জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এটি প্রয়োজনীয়
সরকার আরও বলছে, প্রতিটি মৃত্যুদণ্ড আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পরই কার্যকর করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিচার প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য অনেক সময় প্রকাশ করা হয় না।
সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (MBS) গত কয়েক বছরে দেশকে আধুনিক ও সংস্কারমুখী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
-
নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি
-
বিনোদন খাতের প্রসার
-
ভিশন ২০৩০ প্রকল্প
কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সেই সংস্কারমূলক ভাবমূর্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভবিষ্যৎ কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?
২০২৫ সালের এই রেকর্ড দেখিয়ে দিচ্ছে—
-
সৌদি আরব আপাতত মৃত্যুদণ্ড নীতি থেকে সরে আসছে না
-
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও কঠোর আইন বহাল থাকবে
-
মানবাধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হবে
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি নীতিতে পরিবর্তন না আসে, তাহলে আগামী বছরগুলোতেও মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা উচ্চই থাকবে।
২০২৫ সালে ৩৪০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর শুধু একটি সংখ্যা নয়—এটি সৌদি আরবের বিচারব্যবস্থা, মানবাধিকার অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একদিকে রাষ্ট্রের কঠোর আইন প্রয়োগ, অন্যদিকে মানবাধিকারের মৌলিক নীতির সংঘাত—এই দ্বন্দ্বের সমাধান কীভাবে হবে, সেটাই এখন বিশ্ব দেখছে।

.jpg)
Post a Comment